All posts by Rana Paul

Writer, Photographer and Film Technician.

৩৭

বোলপুরcatsবোলপুর থেকে এগিয়ে প্রান্তিক নামে একটা রেল স্টেশন আছে, সেটাকেও পিছনে ফেলে রেখে রেল লাইনটা টপকে এগিয়ে গেলে, হাইওয়ে আর রেল লাইন পাশাপাশি চলতে থাকে। কখনও কাছাকাছি আসে আবার কখনও দূরত্ব বাড়ে। একটু খেয়াল করলে দূরে রেল লাইনটা চোখে পড়বে।

ছবিটা তোলা শিউড়ি মোরের কাছে।

সেদিন আমরা বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে শুটিং করেছি। বৃষ্টিতে ভিজে নেচেছি। তার কথা মনে পড়ছিল বার বার।

৩৬

নতুন শুটিং

কাল থেকে নতুন ছবির শুটিং শুরু। বেশ কয়েকদিন হয়ত ব্লগ লিখতে আসা হবে না। আমি ফাঁক পেলেই উঁকি মারব বটে তবে নির্দিষ্ট করে এখনই কিছু বলতে পারি না। কাজের বাইরে এই কম্পিউটার-ই আমার বন্ধু। অতএব শত কাজে ক্লান্ত হয়ে ফিরেও এর কাছে একবার বসব হয়ত। ব্লগের আঙিনায় ঘুরে যাবার চেষ্টা থাকবে। বন্ধুরা ভালো থাকবেন।

৩৫

ধূম পান

বাবা এখন নেই। যখন ছিলেন তাঁর সামনে ধূম পান করিনি কখনও। মায়ের সামনে করেছি।এখন করিনা অন্য কারণে, মার হাঁপানী আছে, তাঁর অসুবিধে যেন না হয় তাই সেই ঘরে বসে ধূম পান করিনা।

আমাদের চলতি বাংলায় তো পান নেই। সবই আমরা খাই। জল, সিগারেট সবই।মার সামনে সিগারেট খেতে মা-ই নিজে অনুমতি দিয়েছিল। সেটার একটা গল্প আছে।আমার পরের বোনের সবে তখন বিয়ে হয়েছে।নতুন জামাই শ্বশুর বাড়িতেএসে জমিয়ে সিগারেট ফুঁকছে আর আলমারীর গায়ে লাগানো লম্বা আয়নায়

তার বিবাহোত্তর চেহারার চেকনাই নিরীক্ষণ করছে। ঘরের দরজা দিয়ে হঠাৎ আমার মা অর্থাৎ তার শশ্রুমাতার প্রবেশ। জামাই তো দেখেছে আয়নায়।ম্যাজিক রিফ্লেক্সে সিগারেট সমেত হাত চলে এসেছে তার পেছনে। কিন্তু সেদিকেই যে মা, আয়নার ভেতরে তো নয়।মা ঘর ছেড়ে চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালো।শোনো তোমরা আমার সামনেই সিগারেট টেট খাওতো, নাহলে তোমাদের সাথে আমার কথাই বলা হবে না। এই আমাদের বড় জামাইয়ের হাত ধরে মা-র সামনে সিগারেট খাওয়া শুরু।

আমি নিয়মিত সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি অনেক পরে, প্রায় গ্রাজুয়েশনেরও পরে।ইদানিং মা অনেকবার বলেছে, সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দে।মেয়েরাও ইঙ্গিতদিয়েছে ছেড়ে দিলে তারা খুশী হবে।ভালো চেয়েই অনেক স্বজনেরা বলেছে একইকথা।

নিজে থেকে সিগারেট ছেড়ে দেবার কথা তেমন করে কোনোদিন ভাবিনি।বাধ্য হয়ে একবার জন ডিস্‌এ আক্রান্ত হয়ে সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম দীর্ঘ ছ’মাস।আবার শুরু হয়ে গেছে অজান্তেই। সকলের কথা শুনে মনে হয়েছে, ছেড়ে দিলে মন্দ হয় না।একবার চেষ্টা করে তিন মাস খাইনি। তারপর যে কে সেই।

আসলে সিগারেট ছেড়ে দেবার উপযুক্ত কারণ খুঁজে পাইনি তেমন।একমাত্র কারণ, বেশীদিন বাঁচতে পারব হয়তো। বেশীদিন বাঁচার সাধ আমার নেই।ভালোবাসাহীন প্রাণ যত বাঁচবে, কষ্টের পরমাণও তো তত বাড়বে। তাই না?এই যেমন পক্ষে বিপক্ষে দুদিকেই যুক্তি দেখালাম, এমনই মোক্ষম দুটি যুক্তি এতদিনে আমি দু দিকে দাঁড় করাতে পেরেছি।এক, এক প্যাকেট সিগারেটের বদলে এক কিলো চাল হয়ে যায়।সংসারী মানুষেরা এই কথাটার মানে বুঝবেন।আর উলটো দিকে, এখনও বড়টাকার নোট ভাঙানোর সবচেয়ে সহজ উপায় এক প্যাকেট সিগারেট

কেনা। এইজরুরী ব্যাপারটা এড়ানো খুব মুশকিল। যারা মোকাবিলা করেন, অসুবিধেটা বুঝবেন।দেখা যাক কে জেতে।

৩৪

ফেরা

২ জুন ২০০৯
আজ ফিরে যাব।সন্ধ্যেবেলা আমার ট্রেন।সকালে তো সবাই হৈ হৈ করে তৈরী হয়ে অফিস চলে গেছে।খাঁ খাঁ ফ্ল্যাটে আমি একা।বাইরে রোদ মাখামাখি হয়ে এলিয়ে আছে নির্জন দুপুর।রোদের বেশ তাপ।কেউ কোত্থাও নেই।কেবল দুরন্ত বাতাস বড় বড় গাছগুলোর মাথার চুল ঘেঁটে দিচ্ছে বার বার।অপেক্ষায় ছট্‌ফট্‌ করে সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে পড়লাম।কাল সন্ধ্যেবেলা মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।নেটে জানা গিয়েছে আমার টিকেট আর এ সি।ষ্টেশনে এসে দেখি বার্থ পাওয়া গেছে।নতুন ঝক্‌ঝকে কামরা।
আটটা নাগাদ দুন্দ নামের এক ষ্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়াল ট্রেনটা।এখানে ইঞ্জিন বদল হল। বদল হল চলার দিকও। যদি পুণা থেকে পশ্চিম দিকে চলা শুরু করে থাকে, এখন চলেছে পুবে। এ যেন কিছুটা পিছিয়ে এসে জোরে দৌড় শুরু। এখানে সাত আট বছরের একটা ছেলে উঠল আমাদের কামরায়। সারা শরীর ধূলি ধুসরিত। হাফ প্যান্ট, খালি পা, খালি গা। পরণের জামাটা হাতে। সেটা দিয়ে মেঝে মুছতে লাগল। ওরা তো এমন করেই। মেঝে ঝাঁট দিয়ে পয়সা চায়। ও-ও তাই চাইল। এক রুপিয়া দো। আমার কাছে নয়। অপর দিকে বসে থাকা এক দৈত্যর কাছে। দৈত্যই বলতে হবে তাকে। বিশাল চেহারার এক ভদ্রলোক। উনি আবার পরে আছেন বিশালকায় উরু দেখানো হাফ প্যান্ট। হাস্যকর, ভয়ংকরও বটে। সেই দৈত্যটি এবার বালকটির অসহায়তার সাহায্যে তাকে নিয়ে নানান মানষিক অত্যাচারের মজা করতে শুরু করল। এক রুপিয়া কেন? কাকে দিবি? তোরা ক’জন আছিস? গুনে বল। বাচ্চা ছেলেটিও তার সরলতায় উত্তর দেবার চেষ্টা করে যেতে লাগল। শেষে রফা হ’ল, তোর হাতে টাকা দেবনা, কোন খাবার খা, আমি দাম দিয়ে দেব। ছেলেটি বলল, পয়সা না দিলে যে আমায় কিছু দেবে না। লোকটিতো নিষ্ঠুর মজা করে চলেছে। ছেলেটিই বুদ্ধি করে এক আইসক্রিমওয়ালাকে ধরে নিয়ে এলো। লোকটি একটু থতমত। সামলে নিয়ে চোটপাট শুরু করল, আইসক্রিম খায়েগা, তু আইসক্রিম খায়েগা? উলটো ধমক দিয়ে বলল, আইসক্রিম সে পেট নেহী ভরেগা, দুসরা কুছ খা। লোকটি পরিস্কার পাশ কাটাবার চেষ্টা করল। ছেলেটি বিফল মনোরথ হয়ে আলোকিত করিডর বেয়ে পাশের কিউবিকলগুলোর দিকে চলে গেল। এই বার শুরু হল নানান মন্তব্য। এরা সব বদমাইশ, চোর। স্টেশনে এদের লোক দাঁড়িয়ে। সুযোগ পেলেই কারো ব্যাগ বা মোবাইল নিয়ে পালাবে। তারপর গরু ছাগল তাড়াবার মত, হ্যাট হ্যাট, যাঃ যাঃ করে তাড়ানো হল তাকে। এদের কথার কিছুটা তো সত্যি। আমি নীরব দর্শক হয়ে থাকতে বাধ্য হলাম।

৩ জুন ২০০৯
কোলকাতা ফিরতে, এই ট্রেনটায় দুটো রাত কাটাতে হয়। কাল রাত গেছে, আজ রাতটাও যাবে। সকাল দশটা নাগাদ নাগপুর পেরিয়ে গেল। সাড়ে এগারোটা নাগাদ কি একটা জাংশানে থামতে, আইসক্রিম ফেরিওয়ালা এলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সেই দৈত্যটি আইসক্রিম কিনে খেলো। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল, তার কি একবারও কালকের সেই শিশুটির মুখটি মনে পড়ল?

৩৩

আবার পুণায়

কাল উড়ে এসেছি পুণা। এমন বিতিকিচ্ছিরিভাবে কখনও আমি কোথাও যাইনি। ফোনের চার্জার ভুলেছি, পেন ড্রাইভ ভুলেছি, মায় কলমটাও ভুলেছি। প্রথম দুটো না হলেও কোলকাতায় থাকলেও কলমটি আমার সাথে থাকে সর্বদাই। কবিতা বা লেখা মাথায় ধাক্কা মারলেই লেখা অভ্যেস যে আমার। আমি তো আর লিখব বলে বসে লিখতে পারি না। সেই কলমটাও আমার ভুল হল? মানসিক অবস্থা যে কোথায়, এতেই টের পাওয়া যায়। গত ক’দিন নয়, গত ক’মাস ধরে আমার ওপর দিয়ে ঝড় বইছে। আজ সকালে আমার ঘুম ভেঙেছে ছ’টায়, যেমন রোজ ভাঙে। এখানে এসে উঠেছি সম্পর্কে এক ভাগ্নের বাড়ি। ও আবার দু’দিন হল বাড়ি পরিবর্তন করেছে। জুলাই মাসে বিয়ে করবে। ওর হবু বৌ-ও এখানে কর্মরতা। পরিকল্পনা মাফিক, এই ফ্ল্যাটটা ওরা আগে ভাগেই নিয়েছে, কিছু সুবিধে পেয়েছে বলে। পাঁচ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সন্ধ্যের পর হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে তো যায়ই, সামনের দৃশ্যও অসাধারণ। কম্পাউন্ডে লন, শিশু উদ্যান তো আছেই, আর প্যারাবোলার মত ঘিরে আছে, চকলেট বারের মত বাড়িগুলো। একশ আশি ডিগ্রি চোখ ঘোরালে কেবল জানালা আর ঝুল বারান্দা। এসব পেরিয়ে কম্পাউন্ডের মূল গেটের ওপারেই হাইওয়ে। সর্বক্ষণ অবিরত গাড়ির আনাগোনা। তারও দূরে আবছা পাহাড়ের রেখা। এই মূল গেটটি আমাদের বাড়ি থেকে অন্তত আধ কিলোমিটার দূরে। যেহেতু রাস্তাটি সরলরেখায়, তাই চোখে কোন বাধা আসে না।
সকালে আমি যখন উঠেছি, বাড়ির কারো ঘুম ভাঙেনি। আমি এসে ঝুল বারান্দায় দাঁড়ালাম। সকালের স্নিগ্ধতা চারপাশে। গোল হয়ে ঘিরে থাকা ফ্ল্যাটগুলোর মাঝখানের অংশ দিয়ে দেখা আকাশটুকু ঢেকে রেখেছে, অজস্র উড়ন্ত পায়রা। একটা ক্যামেরার অভাব যে সব সময় অনুভব করি।
এমন দৃশ্যের মানে এই সার সার জানলার সম্মুখিন আমি আগেও হয়েছি। প্রতিবার-ই হিচ্‌ককের রিয়র উইন্ডো ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। এক এক জানলায় এক এক গল্প। কেউ ঝুল বারান্দায় এসে সূর্য প্রণাম করছেন। কেউ স্নান সেরে তোয়ালে পরে তুলসী গাছে পেতলের ঘটি করে জল দিচ্ছেন। এক তরুণী এসে তার অন্তর্বাস মেলে দিল দড়িতে। এক মা বোঝাই যাচ্ছে কাজ করতে করতে এসে খাইয়ে যাচ্ছেন তাঁর শিশুকে। শিশুটি বারান্দার রেলিং ধরে নিজের মনে খেলা করছে। একটি জানালার যে পাশটি দেখা যাচ্ছে না, সেখানে একটি আয়না আছে বোঝা যাচ্ছে। তিন চারটি চাকুরে মেয়ে সেখানে থাকে বোঝা গেল। সকালে সবার তৈরী হবার ব্যাস্ততা। ঐ খানটাতে এসেই, কেউ চুল বাঁধছে, কেউ পোষাক ঠিক আছে কি না দেখছে। একজন তো ওখানে দাঁড়িয়ে কসরৎ করে চোখে লেন্স পরল। সকলের চলনে বেরোবার তাড়া বোঝা যায়। এক মা, তাঁর সন্তান খুবই ছোট বোঝা যায় জামার মাপ দেখে, খুব যত্ন সহকারে তিনি সন্তানের ছোট্ট ছোট্ট ন্যাপিগুলো একটা একটা করে দড়িতে ঝুলিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে দিচ্ছেন।
ভোর থেকে তো নীচের পার্কে দৌড়, হাঁটা এসব চলছেই। এক দল আসছে, চলে যাচ্ছে। আবার নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। ঘেমে নেয়ে কেউ জিরোচ্ছে। আমি পাখীর দৃষ্টিকোণে সব দেখে চলেছি নীরবে। পার্কের মাঝখানে পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট তক্তার একটা দোলনা আছে। সেখানে দেখি তিন বয়স্কা বসে গল্প করছেন। একটু দূরে দুই মধ্য বয়স্ক মানুষ সিমেন্টের প্রাচীরের ওপর বসে। তাঁরাও গল্প করছেন। কিছুক্ষণ পর মহিলারা উঠে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখি এই পুরুষ মানুষ দুটিও উঠে ওঁদের অনুসরণ করতে শুরু করেন। আমি বোঝার চেষ্টা করছি, এঁরা কি একই বাড়ির? একই সাথে ফিরে যাবেন অথবা . . . । ও মা, তারপর দেখি, মহিলারা উঠে যাওয়ায় ঐ দোলনাটাই পুরুষদের টার্গেট। প্রায় দৌড়ে গিয়ে সেটা দখল করেন তাঁরা। আমার খুব হাসি পেল।
এই দোলনা নিয়ে একটু পরে আরো একটা মজার ব্যাপার হল। এক মহিলা খালি পায়ে ঘাসের ওপর অনেকক্ষণ হাঁটছিলেন। এবার গিয়ে বসলেন সেই দোলনায়। জিরোবেন নিশ্চয়ই। মাটিতে পায়ের চাপ দিয়ে দুলতেও শুরু করলেন। এবার এদিক ওদিক সন্তর্পনে দেখতে লাগলেন, কেউ দেখছে না তো? তিনি যে কিশোরী হয়ে গেছেন সেই মূহুর্তে।

৩২

কফি হাউস

আবার বছর কুড়ি পরে না হলেও চোদ্দ পনের বছর তো হবেই, আমি কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউসে ঢুকলাম।গতকাল বই পাড়ায় গিয়েছিলাম মেয়ের জন্যে দুটো বই কিনতে।কি যে এক অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভব করলাম, ভূতগ্রস্তের মত প্রবেশ করলাম কাফেটিতে।আনন্দের সঙ্গে দেখলাম, একটুও পাল্টায়নি আমার কফি হাউস।কি সহজে আমরা বলে ফেলি না, আমার কফি হাউস।এক সময় এখানে এত সময় কেটেছে যে, ‘আমার’ না বলে থাকি কি করে।বললাম বটে একটুও পাল্টায়নি, সত্যি কি তাই? কিছু না কিছু তো পাল্টাতে বাধ্য।তবু আপাত দৃষ্টিতে একই আছে সে।প্রথমে ঢুকেই তো দেখলাম ঘোড়ান সিঁড়ির নীচে সেই সিগারেটের দোকানটি এখনও বর্তমান।এক তলা দো-তলার ভাগাভাগি একই রকম।টেবিল চেয়ার একই রকম।হ্যাঁ, কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার যুক্ত হয়েছে।বেয়ারারদের একই রকমের পোষাক, একই রকমের উষ্ণ আতিথেয়তা।একেবারে শেষ মাথায় দুই চেয়ারের একটা ছোট্ট টেবিল পেয়েছি।আমি খুশী।কিছুক্ষণ পরে অন্য চেয়ারটাও টেনে নিল পাশের টেবিলে আসা নতুন অতিথি।প্রথমে তো বসেই আছি, বসেই আছি।কেউ আসে না।অনেকক্ষণ সেই ডুবন্ত মানুষের সাহায্যের আকুতির মত উর্ধ্ব বাহু হয়ে বেয়ারারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম।আধ ঘন্টা বসে থাকার পর কেউ এলো।এখানে এটাই মজার।তাড়া করার জন্যে তো এখানে কেউ আসে না।যৌবন কালে বা ছাত্রাবস্থায় পকেটের স্বাস্থ্য ভালো থাকার কথা নয়।তখন বান্ধবী বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াটাই আসল উদ্দেশ্য।তাই দেরী করে অর্ডার নিতে আসাটা একটা উপরি পাওনা।এমনি তো আর এখানে বসতে দেবে না তাই চাঁদা তুলে কিছু না কিছু নিতেই হয়।আমি আমাদের সময়ের কথা বললাম অবশ্য।এখনকার ছেলে মেয়েদের কথা ঠিক বললাম কি না জানি না।তাদের তো এখন বাতানুকুল কাফেতেই জমায়েত বেশী।এখানে এখনও বেশ সস্তা।স্যান্ডউইচ চেয়েছিলাম, বেশ কিছুক্ষণ পর এসে জানালো ওটা পেতে দেরী হবে।কাল বিলম্ব না করে এখানকার সেই বিখ্যাত পকোড়া দিতে বলে দিলাম।এক প্লেট দশ টাকা।আর এক কাপ কফি আট টাকা।ভাবা যায়? এখানে সবাই জোড়ায় বা দলে এসেছে।সেটাই স্বাভাবিক।আমি একা বোকা বোকা মুখে কিছুটা চোর চোর ভাব।অবশ্য আমার বাঁ পাশের টেবিলে একটি মানুষ একা বসে খস্‌ খস্‌ করে পাতার পর পাতা লিখে যাচ্ছেন।আমার এক মিষ্টি বান্ধবী প্রেসিডেন্সীর ছাত্রী।ও জানত আমি কোন একদিন বই কিনিতে এ পাড়ায় আসব।বলেছিল, আমায় জানাবেন আমি থাকব।আজ এসে খোঁজ করে জানা গেল তিনি আজ বাড়িতে বসে আছেন, আজ আসেনইনি।আমি বললাম, বাহ্‌ মচৎকার।বান্ধবী হেসে বলল, বলেছিলাম আগে জানাতে, যেমন কর্ম তেমনি ফল।কিছুদিন আগে এই কফি হাউসের দেড়শ বছরের জন্মদিন পালিত হয়েছে, ধূমধাম করে।ট্রাম লাইন ধরে ধীর পায়ে ফিরে আসতে আসতে চোখে পড়ল, ইউনিভার্সিটির বয়সও দেড়শ পেরিয়েছে।আমি মনে মনে ভাবলাম, দুই প্রাচীন বন্ধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই শহরটাকে বয়সে বুড়ি আর চলনে ছুঁড়ি হতে দেখছে, আর নির্ঘাত মুচ্‌কি মুচ্‌কি হাসছে।

৩১

ছবি তোলার ঝক্কি

অনেকদিন আগে, সেই কলকাতা দূরদর্শনের সাদা কালোর যুগে একটি সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান হ’ত।পরিচালনা করতেন অভিনেতা অরুন বন্দ্যোপাধ্যায়।তেমন এক অনুষ্ঠানে একদিন অতিথি ছিলেন লেখক নারায়ণ সান্যাল এবং চিত্র পরিচালক তরুন মজুমদার।নানান কথার পরে তরুন বাবু বলেছিলেন, দেখুন নারায়ণ বাবু, আপনি এক পাতা লেখার পর আপনার মনে হল লেখাটা কিছুই হয়নি বা মন মতো হয়নি, আপনি সেটাকে দলামোচা করে ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন পাতায় নতুন করে লেখাটা লিখতে শুরু করতে পারেন।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আমি এক রোল ফিল্ম শ্যুট করার পর অবলীলায় তা ফেলে দিতে বাঁধবে কারণ তার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ টাকা জড়িয়ে আছে।এমনটা যে হয়না তা নয়, কাজটাকে পারফেক্সনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে তা অনেক সময়ই করতে হয়।তবে সব সময় মনে রাখতে হয় টাকাটা অন্য একটি মানুষের এবং তাঁর কাছে জবাবদিহি করা জরুরী।অতএব কাজে নামার আগেই কাজ থাকে বিস্তর।যা চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাষায় প্রি প্রোডাক্সন।সেটা খুব যত্ন সহকারে করা প্রয়োজন।এতো দিন পর এই কথাটা উল্লেখ করার কারণ হঠাৎ একটা লেখা পড়তে গিয়ে এই কথারই প্রতিধ্বনি শুনলাম, যা বহুদিন আগে অরসন ওয়েলেস বলে গেছেন।তিনি বলেছেন, A poet needs a pen, a painter a brush, and a filmmaker an army.

৩০

বাঙালী এক সূত্রে বাঁধা থাকুন

গত পঁয়তাল্লিশ বছরের নীরিখে গতকাল নাকি কোলকাতার তাপমাত্রা চরমতম সীমায় পৌঁছেছিল। মশারীর মধ্যে হাওয়া ঢোকেনা, তবু মশার জ্বালায় সেটি টাঙাতেই হয়। এপাশ ওপাশ করতে করতে উঠেই পড়লাম। পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখলাম। রাত তিনটে কুড়ি। এই লেখা লিখতে বসলাম। গরমের থেকেও অন্য তাড়না আমায় শুয়ে থাকতে দিল না। আজ সন্ধ্যে থেকেই যা আমায় ভেতরে ভেতরে উত্তক্ত করছে, শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।

নববর্ষ অবধি মেনে নেওয়া গিয়েছিল। না হয় ধরেই নিলাম ইংরেজী সনের একটি নির্দিষ্ট দিন নববর্ষের জন্য ধার্য করা হয়েছে, ১৪ ই এপ্রিল। কিন্তু এটা মেনে নিলে, এখন দেখছি অসংখ্য ভুলের মধ্যে, জটিলতার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে বাঙালীকে।

এ তো মহা জ্বালা হল। রবি ঠাকুর, যিনি কি না বাঙালীর কাছে সর্ব শক্তিমানের সমতূল্য, তাঁর জন্মদিন, তা কি না দুই ভিন্ন দেশে, দুই ভিন্ন দিনে পালিত হবে? এ কখনই মেনে নেওয়া যায় না। বাঙালীর মেনে নেওয়া উচিত নয়। আমাদের বুঝতে দেরী হল, কিন্তু এটা নতুন করে বাঙালীকে বিভাজিত করার চক্রান্ত মাত্র। সারা পৃথিবীর বাঙালীর কাছে আমার আবেদন, এটা মেনে নেবেন না। বাঙালীর জন্যে গঠিত সেই আদি বঙ্গাব্দকে অনুসরণ করুন। সকল বাঙালী এক সূত্রে বাঁধা থাকুন।

২৯

ট্যাগিং

কখনও কোথাও ভাল কিছু লেখা পড়লে মনে হয় প্রিয়জনদেরও পড়াই।তাদের সাথে সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা করি।ঠিক এই কথাগুলিই আমি কিছুদিন আগে লিখেছিলাম।এ অবধি না হয় ঠিক আছে।তারপরের পর্যায়ে এই যে বন্ধুদের নাম যুক্ত করা, আন্তর্জাল জগতের ভাষায় যাকে ট্যাগ্‌ড্‌ করা বলা হয়, এই তাদের নাম জুড়ে দিয়ে তাকে লেখাটি পড়তে বাধ্য করা, এটা কি ঠিক করছি? ভদ্রতার খাতিরে তাকে কিছু লিখতেই হয়।এই যে জোর করা।এই যে সে কি লেখা পড়বে না পড়বে, কোন লেখা তার ভালো লাগবে, না লাগবে, একটি নির্দিষ্ট দিকে তাকে চালিত করা, এটা কি ঠিক? না কি ব্যাপারটা তেমন নয়।আমি ভুল ভাবছি? একবার মনে হয় বন্ধুদের প্রতি অবিচার করছি।তাদের পছন্দ, অপছন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি।আবার মনে হয়, সকলের তো সব লেখা পড়বার সুযোগ হয় না, এই পদ্ধতিটি এক ধরণের আলোকপাত নয় কি? আমিও তো চাই আমার বন্ধুরাও আমার চলার পথে এমন নানান আলো ফেলুন।এ লেখা পড়তে কাউকে বাধ্য করলাম না।অর্থাৎ কাউকেই ট্যাগ্‌ড্‌ করলাম না। দেখি ক’জন স্ব ইচ্ছায় পড়ে।

২৮

হেলা ফেলা

এটা আমার অনেকদিনের অভ্যেস, কোন লেখা পড়লে, যে অংশ ভালো লাগে, লিখে রাখতাম। কাছের কিছু বন্ধুর সাথে তা নিয়ে আলোচনাও হতো। এখন এখানে আরো বেশী বন্ধুর সাথে চিন্তাটা ভাগ করে নেবার সুযোগ থাকায়, লোভ সম্বরন করতে পারিনা। এটাও আশা করি, অন্য বন্ধুরাও তাদের পড়া কিছু ভালো লাগা লেখা আমার সাথে ভাগ করে নেবে। বিপুল ভান্ডারের কতটুকুই বা পড়তে পারি। তবে এটাও ঠিক, আমার যা ভালো লাগলো, সকলের তা পছন্দ নাও হতে পারে। যদি জানতাম এ লেখা আমার বন্ধুদের এমন বিষাদগ্রস্ত করে দেবে, আমি পড়াতাম না। জন্মের মূহুর্ত থেকেই তো উলটো গণণ শুরু হয়ে যায়। আর কিছু নাই হোক, মৃত্যু একটি প্রাণের অবশ্যম্ভাবী। আমার মনে হয়, এ সেই ছোটবেলার কমলালেবু রেসের মত, যে কমলালেবুটি নিতে ব্যর্থ হয়েছি, তার পিছনে কাল অতিবাহিত না করে, ছুটে যাওয়া উচিত পরের কমলালেবুটির দিকে। অনেক কাজই পরে রইলো, পরে রইলো অসমাপ্ত।থাকুক।হেলা ফেলা এও এক খেলা। সবাই তো সে খেলার নিয়ম জানেনা। কাজ নিয়েই মেতে রইল বেশীরভাগ লোক।