রানা পাল এবং আমি

আমার জন্মের প্রায় দু মাস আগে আমার প্রিয়তম কবি জীবনানন্দ দাশ পথ দূর্ঘটনায় মারা যান। আমরা একই শহরের বাসিন্দা হয়েও একই আকাশের নীচে, একই বাতাসে, এক সাথে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। অন্ততঃ মারা যাবার সময় তিনি কলকাতা বাসীই ছিলেন।

জীবনানন্দের সাথে সব সময়েই একটা আত্মীক যোগাযোগ অনুভব করেছি হৃদয়ে। তাঁর মত আমার পূর্ব পুরুষেরাও ছিলেন, অধূনা বাংলাদেশের বরিশাল বাসী। আমার বাবা ছিলেন বি এম কলেজে জীবনানন্দের ছাত্র। জীবনানন্দ আমার জীবনে নানানভাবে জড়িয়ে আছেন।

ঠিক কবে থেকে লিখছি ভাবতে বসে দেখলাম, জ্ঞানতই আমার এই লেখালেখির প্রবণতা। এটা খুব ভালো মনে আছে, আমার বারো বছর বয়সে আমি একটি সম্পূর্ণ গান প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। অর্থাৎ গানটির কথা, সুর সবই আমার রচিত ছিল। কিন্তু প্রথম ছাপা কবিতা স্কুলের ম্যাগাজিনে। তারপর পাড়ার পুজো পত্রিকায়। অবশেষে কৌরব-এ। এক অন্য পথ চলা শুরু।

এই কবিতা লেখার জন্যে বাড়ি থেকে কখনই কারো সায় পাইনি। উলটে অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। মন দিয়ে পড়াশুনো করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হই, এটাই আমার মায়ের ইচ্ছে ছিল। কবিতা লিখে কে কবে বড় হয়েছে? সেই গঞ্জনাকে পাথেয় করে যেমন আমার অনেক লেখা পুড়িয়ে দিয়েছি, সারা রাত বালিশ ভেজানো কান্নার পর লিখেও ফেলেছি নতুন একটি কবিতা। আজ সেই পুড়িয়ে ফেলা কবিতাগুলির জন্য আক্ষেপ হয়।

আজ এখন একটা কবিতা লিখব বলে আমি লিখতে পারি না। কোনোদিন সেভাবে লিখিওনি। কবিতাটির শুরু বা কোন একটি অংশ হঠাৎ আমার মাথায় আঘাত করে। তারপরেই ঝরঝরিয়ে ঝর্ণার মত তার মর্তে অবতরন। আমার মাথায় এই কবিতার আঘাত যে কোন সময় আসতে পারে এবং সেই সময়েই ওটাকে নাড়াচাড়া করে একটা খসরা করে ফেলি। আমার ‘খড় শূণ্য নীড়’ কবিতাটি বাসের ফুটবোর্ডে ঝুলতে ঝুলতে নির্মাণ করেছি। তখনই লিখতে পারিনি। বাসে ঝুলন্ত ছিলাম বলে নয়, অনেক বছর আগের কথা, তখন পকেটে কলম কাগজ নিয়ে ঘুরতাম না। পরবর্তীকালে নিয়ম করে পকেটে একটি ছোট প্যাড রাখার চেষ্টা করি। ‘নির্ণীয়মান অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে’ কবিতাটি ওইরকম একটি নির্ণীয়মান বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পরে লিখে ফেলি।

কবিতা মানুষের গহীন থেকে উঠে আসা অনুভূতির কুসুমিত, পল্লবিত রূপ। একে কোন গন্ডি দিয়ে, বেড়া দিয়ে, আধুনিক বা মান্ধাতা আমলের তক্‌মা দিয়ে কলুষিত করা উচিত নয়। যে কোন কবিতাই চিরকালীন। মানুষ জীবন ধারায় প্রগতিশীল হয়েছে। বুদ্ধি বিবেচনায় অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু তার কষ্ট, আনন্দ, প্রেম, হিংসে এই অনুভূতিগুলো সেই সৃষ্টির দিন থেকে আজও একই। মানুষের মনের অনুভূতিই হল কবিতার উৎস। একে কোন বাঁধনে বাঁধতে আমি নারাজ।

দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া পাখীটার নাম কবিতা। অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে বেরানো বাতাসের নাম কবিতা। পর্দার আড়ালে উঁকি মারা শিশুটির নাম কবিতা। অভিমানে বৃষ্টিতে হেঁটে যাওয়া মানুষটির নাম কবিতা। কবিতাকে ধরা যায় না। অনুভব করতে হয়।

চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিচালনা বিভাগের একজন সাধারণ কর্মী আমি। অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ হয়ে ওঠায় আমার সামান্য অবদান সহ যুক্ত থাকতে পেরে কিছুটা গর্ব অনুভব করি। তবু কবিতা আমার প্রাণ। কবিতা আমার প্রথম ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল কবিকে আমি শ্রদ্ধা করি, বন্ধু ভাবি, ভালোবাসি। আমার সাধ পৃথিবীর মানুষের কাছে আমার পরিচয় হোক, আমি একজন কবি।

রানা পাল

phone: +919836568956

mail: oorochithi@gmail.com

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান